জহির খান, উজিরপুর ॥ লাগামহীন অনিয়ম-দূর্নিতী করে বরিশালের উজিরপুরে সরকারি কাজের টাকা ভাগাভাগির ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্থানীয় সরকার বিভাগ। উপজেলার ৩ নম্বর জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের এ ঘটনা নিয়ে গোটা জেলা জুড়ে চলছে সমালোচনার ঝড়।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদার ও নারী সদস্য দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালসহ জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপরই বরিশালের ‘টক অব দ্যা টাউন’র এ বিষয়টি স্থানীয় ও জেলা প্রশাসনের নজরে আসে।
যদিও তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে সংবাদকর্মীদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বিষয়টি ধামাচাঁপা পড়ে যায়। কারণ সরকারি টাকা ভাগাভাগিতে স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি ওই ফোনালাপের রেকর্ডে স্পষ্ট। গত বুধবার (১০ ফেব্র“য়ারি) বিকেল ৪টা ৩২ মিনিটে মোঃ জুনায়েদ সিদ্দিক নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ফোনালাপের ওই অডিও রেকর্ডটি ভাইরাল হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার একাধিক সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরন করেন জল্লা ইউপির ৪,৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের নারী সদস্য দিপালী হালদার।
এমন অভিযোগে সম্প্রতি নারী সদস্য দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদারসহ সকল সদস্যরা উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার নিকট অনাস্থা দেন এবং কয়েকদিন পরেই স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে তাকে (দিপালী) কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক সপ্তাহ আগে নারী সদস্য দিপালী হালদার তার বিরুদ্ধে দেয়া অনাস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়ে চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদারের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে (০১৭৪০-৬৭০…) কল করে কথা বলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের ওই অডিও রেকর্ডটি সেই ফোনালাপের। চেয়ারম্যান ও মেম্বারের ফোনালাপের রেকর্ডটি কীভাবে ফাঁস হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ওই ফোনালাপে হতদরিদ্রের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পের (৪০ দিনের) নামমাত্র কাজ করিয়ে সরকারের টাকা তুলে নেওয়ার পরে তা ভাগবাটোয়ারার বিষয়টি স্পষ্ট।
একইসঙ্গে চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা প্রশাসনকে ঘুষ দেওয়ার পরও কেন ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে তা জানতে চাওয়া নিয়ে তর্কের বিষয়টিও স্পস্ট। এ বিষয়ে নারী ইউপি সদস্য দিপালী হালদারের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি কথোপকথন থাকা কণ্ঠ তার বলে নিশ্চিত করেছেন।
একই সাথে যে ফোনালাপ হয়েছে তা সম্পূর্ন সত্য জানিয়ে তিনি বলেন, মোবাইলটি তার ছেলের কাছে ছিলো, সেখান থেকে যে কেউ মোবাইলটি নিয়ে কী করেছে সেটা সঠিক বলতে পারছি না। তবে এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে চাননি অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদার। তবে তার দাবি কণ্ঠ নকল করে অডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অয়ন সাহা বলেন, ‘অনিয়মের অভিযোগে বেশ কয়েকটি কাজের টাকা আমরা আটকে দিয়েছি। টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানান, তিনি কোনো ঘুষ নেননি।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণতি বিশ্বাস বুধবার (১৭ ফেব্র“য়ারি) দুুপুরে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, ‘ফাঁস হওয়া ফোনালাপের বিষয়ে তিনিসহ জেলা প্রশাসক মহোদয় অবগত রয়েছেন। ওই অডিও রেকর্ডটিতে কোনো বিষয়ে বা কারও বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরদিকে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদার রহস্যজনক কারণে আজ পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকায় নানা ধরনের সমালোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। ওই জনপ্রতিনিধির কারণে সরকারের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কর্মসূচির কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অদম্য গতি স্বাভাবিক রাখতে ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদারের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।
প্রসঙ্গত, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পর্যায়ে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (৪০ দিন) প্রকল্পে উজিরপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ৩০৫৭ জন শ্রমিকের কাজের জন্য ২ কোটি ৫৯ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৩ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মোট ৬৬টি প্রকল্পের জন্য সরকারের ওই বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে জল্লা ইউনিয়নের ৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৪১ জন শ্রমিকের কাজের জন্য ২৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, ওই ইউপির সবগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করে প্রকল্পের সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যানসহ তার অন্যান্য জনপ্রতিনিধিরা বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা লোপাট করেছেন। সেই টাকার ভাগাভাগি নিয়েই এ ফোনালাপটি ফাঁস হয়।