উজিরপুর (বরিশাল) সংবাদদাতা::
অনিয়ম-দুর্নীতি করে সরকারের উন্নয়ন কাজের টাকা আত্মসাত ও ভাগাভাগির ফোনালাপ ফেসবুকে ভাইরালের ঘটনায় বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউপি চেয়ারম্যান এবং আসন্ন ইউপি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী বেবী রানী হালদারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিটে দায়েরকৃত অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদকের বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে গত রোববার (২৮ মার্চ) ওই তদন্তটি শুরু হয়। সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মোঃ আল-আমিনের নেতৃত্বে দুদকের একটি টিম ওই দিন বিকেলে উপজেলার জল্লা ইউপির কারফা বাজারে চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদারের অস্থায়ী কার্যালয়ে গিয়ে তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে তদন্ত শুরু করে।
এ সময় দুদকের ওই টিমের সদস্যরা সরেজমিনে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পসমূহ পরিদর্শন এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তার (পিআইও) দপ্তর হতে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেন। বিষয়টি সম্পর্কে দুর্নীতি প্রতিরোধকারি সরকারি ওই সংস্থাটি তাদের “অহঃর-ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ ঈড়সসরংংরড়হ- ইধহমষধফবংয” নামের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে উপজেলার জল্লা ইউপি চেয়ারম্যান বেবী হালদারের সাথে দুদক টিমের আলাপকালের একটি ছবি পোস্ট করে তদন্তের বিস্তারিত তুলে ধরে। পরে বুধবার (৩১ মার্চ) দুপুরে সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ বিষয়ে দুদকের বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মোঃ আল-আমিন মুঠোফোনে জানিয়েছেন, সরকারি কাজের টাকা ভাগাভাগির ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় জল্লা ইউপির চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদার ও সদস্য দিপালি হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের হটলাইনে একাধিক অভিযোগ আসে।
এর প্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে গত ২৮ মার্চ তার নেতৃত্বে একটি টিম ফোনালাপ ফাঁসের ওই ঘটনার তদন্ত করে। তিনি আরও জানান, তদন্তের সময় তিনিসহ টিমের অন্যান্য সদস্যরা সরেজমিনে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পসমূহ পরিদর্শন করেন। পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রণতি বিশ্বাস ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা (পিআইও) অয়ন সাহাসহ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে কথাও বলেছেন। এরপরই তদন্ত অনুযায়ী দুদকের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে বলে জানান সরকারি সংস্থাটির এই কর্মকর্তা।
সূত্রে জানা গেছে, গ্রামীণ জনপদ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতি করে সরকারের টাকা লোপাটের পরে তা ভাগাভাগি নিয়ে উপজেলার জল্লা ইউপির চেয়ারম্যান বেবী হালদার ও সদস্য দিপালি হালদারের ফোনালাপের একটি অডিও রেকর্ড গত ১০ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। ফোনালাপের ওই অডিও রেকর্ডটি “মোঃ জুনায়েদ সিদ্দিক” নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। রেকর্ডটি কীভাবে ফাঁস হয়েছিল তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের ফোনালাপের ওই অডিও রেকর্ডে হতদরিদ্রের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পের (৪০ দিনের) নামমাত্র কাজ করিয়ে সরকারের টাকা তুলে নেওয়ার পরে তা ভাগবাটোয়ারার বিষয়টি স্পষ্ট।
একইসঙ্গে চেয়ারম্যান বেবী হালদারের নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা প্রশাসনকে ঘুষ দেওয়ার বিষয়টিও স্পস্ট ছিল। ওই ঘটনায় গোটা জেলা জুড়ে সমালোচনার তুঙ্গে ছিলেন দুর্নীতিবাজ উভয় নারী জনপ্রতিনিধি। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনসহ দলীয় নেতাকর্মীরাও চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। দুর্নীতির ফোনালাপের ফাঁসের ওই ঘটনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় পর্যন্ত গড়ালেও রহস্যজনক কারণে বিষয়টি ধামাচাঁপা পড়ে যায় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগকেও দেখা গেছে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান-সদস্যের ব্যাপারে উদাসীন ভূমিকায়।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ইউপি নির্বাচনে উপজেলার জল্লা ইউপির দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদারকেই আ’লীগের দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ২৩ মার্চ দুপুরে ওই ইউনিয়ন আ’লীগ ও তার সকল সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীসহ এলাকাবাসী বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের সানুহার বাসষ্ট্যান্ডে ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ মিছিল করেছিল। সেখানে বিক্ষোভকারিরা দলের পদ-পদবী বিহীন বিতর্কিত ওই চেয়ারম্যানের মনোনয়ন বাতিল করে সৎ, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের হাতে উন্নয়নের মার্কা নৌকা প্রতীক তুলে দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি জানিয়েছিলেন। এমনকি ওই মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ইউনিয়নবাসী “ছিঃ ছিঃ ছিঃ লজ্জা, দুর্নীতিবাজ বেবীর হাতে উন্নয়নের নৌকা, মানি না মানি না।
দাবি মোদের একটাই দুর্নীতিবাজ বেবীর মনোনয়ন বাতিল চাই” সহ বিভিন্ন শ্লোগান লেখা প্লাকার্ডও প্রদর্শন করেছিলেন। ওই সূত্রটি আরও জানায়, এতোটা বিতর্কিত হওয়ার পরেও দুর্নীতিবাজ ওই চেয়ারম্যানের মনোনয়ন বাতিল না করে আসন্ন ইউপি নির্বাচনে তাকেই নৌকার প্রার্থী করায় দলের ত্যাগি নেতাকর্মী-এলাকাবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। আর সেই ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ হিসেবে ভোটের মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটতে পারে। এলাকার সচেতন মহলের দাবি, জল্লা ইউনিয়নবাসীর সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি, প্রকল্পের কাজ, টিআর, কাবিখা থেকে টাকা নেওয়া সবকিছুই নিয়ন্ত্রন করে চেয়ারম্যান বেবী ও তার পরিবারের সদস্যরা।
এমনকি দলীয় নেতা-কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করে এলাকায় পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে। তাছাড়া আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে নৌকার প্রার্থী বেবী হালদার তার ভাসুরপুত্র অলোক হালদারকে দিয়ে আশপাশের উপজেলা থেকে বহিরাগত অস্ত্রধারিদের এলাকার ঢুকিয়ে সাধারণ ভোটারদের হুমকি দেয়াচ্ছেন। একই কথা জানিয়ে অভিযোগ করেন নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বি আ’লীগের বিদ্রোহি প্রার্থী উপজেলা আ’লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান উর্মিলা বাড়ৈ। তবে এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে নৌকার প্রার্থী ও জল্লা ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদারের সাথে যোগাযোগের জন্য তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি।